বসন্তে অপরূপা আনাতোলিয়ার আকদামা দ্বীপ 

প্রাচীন স্থাপত্য আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ মিশেল ইউরোপের মুসলিম প্রধান দেশ তুরস্ক। অটোমান সাম্রাজ্যের হাতে বিকশিত এ দেশটির অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন স্থানের মধ্যে আকদামা দ্বীপটি সত্যিই মনোহর।

পূর্ব আনাতোলিয়ার এ দ্বীপের আকর্ষণে প্রতি বসন্তে সেখানে ছুটে যান হাজারো বিদেশি পর্যটক। তবে তাদের সবাই যে কেবল লেকের প্রেমে পড়েই সেখানে ছুটে যান তা নয়। মূলত এ দ্বীপের মূল আকর্ষণ আকদামা চার্চ। প্রাচীন অনন্য স্থাপনার এ চার্চটি এতোটাই দৃষ্টিনন্দন যে তুরস্ক ভ্রমণকারী কোনো পর্যটকই এটিকে মিস করতে চান না। বিশেষ করে আনাতোলিয়া যারা যান তারা।

বসন্তে লেক ঘিরে অসংখ্য কাঠ বাদাম গাছ তার গোলাপী-সাদা রঙে প্রাকৃতিকভাবে সাজিয়ে তুলেছে। সেইসঙ্গে সেখানকার বায়ুমণ্ডলে তৈরি এক ধরনের সজীব-স্নিগ্ধ পরিবেশ। তবে বেশ কিছু ছোটো-বড় পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে স্বচ্ছ নীলাভ জলের এ লেক কিংবা পুরো এ দ্বীপটির আসল তারকা হলো আকদামা চার্চ। আর্মেনিয়ান অর্থডক্সদের এ চার্চটি পবিত্র ক্রস চার্চ নামেও পরিচিত।

মধ্যযুগে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের এ ছোট্ট দ্বীপ রাষ্ট্রটি ছিল ভাসপুরাকান রাজ্যের অধীন। দশম শতাব্দীতে অর্থাৎ ৯১৫ থেকে ৯২১ সালের মধ্যে আর্মেনিয়ার রাজা গগিক ই আরজরুনি বিসপ ম্যানুয়েল নামের দেশটির একজন বিখ্যাত স্থপতিকে দ্বীপটিতে একটি গির্জা স্থাপনের সিদ্ধান্তের কথা জানান। মূলত এই স্থপতিই গির্জাটির নকশা করেন। যিশু খ্রিস্টকে যে ক্রুশে বিদ্ধ করা হয়েছিল এটাকে সেই প্রকৃত ক্রস বলেই বিশ্বাস করা হয়।

গির্জাটি বঙ্গোপসাগরে হিপ্পিসিম চার্চের অনুকরণে ‘হ্রিপাইম টাইপ’ নামের একটি স্টাইলে নির্মিত। এটি একটি চার-স্তরীয় ক্লোভার-মত, ভল্ক্যানিক তুফায় ক্রস-আকৃতির পরিকল্পনায় নির্মিত। গির্জার এলাকায় আগ্নেয়গিরির পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে, এটি একটি রঙিন মুখোমুখি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তার পশ্চিম প্রাচীরটিতে রাজা গগিকের বর্ণনা রয়েছে। যিশুর কাছে গির্জার একটি মডেল উপস্থাপন করা এবং পূর্ব প্রাচীরের মাঝামাঝি আব্বাসীয় খলিফা মুক্তাদিরকে চিত্রিত করা হয়েছে। ইউনুস, শিশু যিশুর সঙ্গে মরিয়ম, আদম ও হাওয়ার স্বর্গ থেকে হুকুম, গলিয়াতের সঙ্গে দাউদের যুদ্ধ, শিমোন কর্তৃক এক ফিলিস্তিনিকে হত্যা, তিন ইহুদি যুবক এবং সিংহের ঘরে দানিয়েল এমন গুরুত্বপূর্ণ  অনেক দৃশ্য ছিল। যা রূপকভাবে ফুটিয়ে তোলা।

ধর্ম ও সংস্কৃতির মিশেল

আর্মেনিয়ায় অন্য যেসব অর্থডক্স গির্জা রয়েছে আকদামার গির্জাটি সেগুলো থেকে আলাদা। অভ্যন্তরের ফ্রেস্কোগুলো পৃথক পৃথক ভাবে সেট করা। এ ফ্রেসকোগুলি স্রষ্টার সৃষ্টি এবং যীশুর জীবনের নানা ধাপ ফুটিয়ে তোলে। এ গির্জার অধিকাংশ ফ্রেস্কো এখনও হুবহু সুরক্ষিত রয়েছে। তবে যে অল্পকিছু ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সেগুলো পুরোপুরিই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব এবং এর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কারণে জাতিসংঘের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ২০১৫ সালে এ গির্জাটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতির জন্য প্রাথমিকভাবে তালিকাভুক্ত করে।

আকদামার গির্জাটি কেবল আর্মেনীয় কিংবা অর্থোডক্সিদের শিল্পের স্মারকই নয়, এটি পূর্ব আনাতোলিয়ার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং ভাসপুরাকানের রাজত্বের মহিমাও প্রতিফলিত করে। ভবনটি বাইবেল এবং ওল্ড টেস্টামেন্টের জ্যামিতিক এবং ফুলের মূর্তিগুলোর সঙ্গে ইসলামি শিল্পের উপাদানগুলোর যে অপূর্ব সমন্বয় রয়েছে সেগুলো ফুটিয়ে তোলে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা-তুরস্কের অসংখ্য সৈন্য নিহত হয়। যুদ্ধ শেষে ১৯১৫ সালে চার্চটি পরিত্যক্ত হিসেবে ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া ভূমিকম্প এবং কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কবলেও পড়েও বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এ স্থাপনাটি।

তবে ২০১৫ সালে দেশটির পর্যটন ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এটির সংস্কারের জন্য ৪ মিলিয়ন টার্কি লিরা বরাদ্দ করে। দুই বছরের মধ্যে আকদামা গির্জাটি নতুন করে জেগে উঠে পুরনো অবয়ব নিয়ে।

 

টাইমস/এমএস/জেডটি

Share this news on: